বাংলাদেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে হাকালুকি হাওর বিস্তৃত। অনেকগুলো বিলের সমন্বয়ে সৃষ্ট এটি দেশের বৃহত্তম হাওর। ২৩৬টি বিল নিয়ে এই হাকালুকি হাওর।
‘ডাকে পাখি, খোল আঁখি
দ্যাখ সোনালি আকাশ,
বহে ভোরেরও বাতাস।’
শীতের অলস সকালে সুরেলা পাখির মিষ্টি গানে সবার ঘুম ভাঙে। আমাদের দেশের মানুষ ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে পাখির ডাকে। আবার দিনের শেষে সন্ধ্যাও নামে পাখির কলকাকলিতে। বিদায়ি সূর্য যখন রক্তিম আভা ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে মিলিয়ে যায়...। সেই আলো-আঁধারির খেলায়, মায়াবী সন্ধ্যায় ঝাঁক বেঁধে পাখিরা আপন গন্তব্যে ফেরার অভূতপূর্ব দৃশ্য মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে দেয় চারপাশে, দেহমনে। পাখি যেন প্রকৃতির অলংকার, এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকি এখন শীতে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর। প্রতিবছর সাইবেরিয়া, লাদাক অঞ্চল থেকে প্রচুর অতিথি পাখির সমাগম ঘটে হাকালুকিতে। এই হাওর অতিথি পাখিদের নিরাপদ অভয়াশ্রম ছিল। তবে গত কয়েক বছর থেকে হাওরটি অতিথি পাখির আর অভয়াশ্রম নেই বললেই চলে। সমস্যা পাখি নিধনকারী চক্র। নিষ্ঠুর শিকারির নির্মমতায় অতিথি পাখির জন্য অরক্ষিত স্থান হয়ে পড়ে হাকালুকি হাওর। আইন থাকতেও পাখি শিকারের এই অপতৎপরতা কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।
শীতকালে হাওর সাজে এক অপরূপ সাজে। নানা প্রজাতির, বিচিত্র রঙের পরিযায়ী পাখির রাজ্য হাকালুকি হাওর। আর এ সময় অতিথি পাখিদের মতো মানুষের কোলাহলেও মুখর হয়।
শীত মৌসুমে এশিয়ার উত্তরাংশের সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিদের প্রায় ২৫ প্রজাতির হাঁস এবং জলচর পাখি হাওর এলাকায় ভ্রমণে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আমাদের দেশের প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখি। স্থায়ী পাখির সঙ্গে পরিযায়ী পাখির চলার ছন্দ, উড়ার ঢঙ, পাখা ঝাপটানোর কৌশল, সুরেলা কণ্ঠে কিচির-মিচির সুরে গাওয়া মধুর গান ঘর ছাড়া করে পাখিপ্রেমীদের।
কুয়াশার চাদরে মোড়ানো শীতের সকাল। মিষ্টি রোদের উষ্ণ আমেজ। রোদের আলো গায়ে মেখে লুটোপুটি খায় নানা রঙের, বিচিত্র ঢঙের পাখি। হাওরে পরিযায়ী হাঁসের মধ্যে রয়েছে রাজসরালী, গরাদমাথা রাজহাঁস, চখাচখি, ধলাবেলে হাঁস, গাডোয়াল, ইউরেসীয় সিঁথিহাঁস, টিকিহাঁস, পাতিহাঁস প্রভৃতি। আরও অসংখ্য প্রজাতির হাঁসের কুজনে মুখর চারপাশ। দেশি প্রজাতির হাঁসের মধ্যে রয়েছে বেগুনি কালেম, পানমুরসী, পাতিকুট, ডাহুক, ইউরেসীয় মুরগিচ্যাগা, রাঙাচ্যাগা, জলাপিপি, ময়ূরলেজাপিপি, পাতি জিরিয়া, হাট্টিটি, ভুবনচিল, শঙ্খচিল, কুড়াল ঈগল, বড়খোঁপা ডুবুরি, ছোট পানকৌড়ি, খয়রা বক, সাদা বক প্রভৃতি অসংখ্য পাখি। একঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। আরেক ঝাঁক তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। এদের কোনোটা কালো, কোনোটা কালচে খয়েরি, কোনোটা মেটে, আবার কোনোটা ধূসর রঙের। এ যেন নিপুণ কোনো শিল্পীর রঙিন তুলিতে আঁকা স্বপ্নদ্বীপের পাখির ছবি।
এ ছাড়া হাওরের বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। প্রায় ৩২২ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের আবাস। বর্ষাকালে চারদিকে শুধু পানি আর পানির খেলা। তারমধ্যে রয়েছে আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং, কৈসহ আরও নানা প্রজাতির।
অন্যান্য ঋতুতে কম-বেশি পাখি দেখা গেলেও পরিযায়ী পাখি বেশি দেখা যায় শীতকালে। মনোহর এদের তাল, লয়, সুর, ছন্দ, কবিতা। পুলকিত মনের বাধঁভাঙা উচ্ছ্বাস, আনন্দ, উল্লাস। সেই মাধুর্যময় আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ছোঁয়ায় উদ্বেলিত হয় হৃদয়ের অলিগলি, তৃপ্ত হয় মন। পূর্ণতা পায় চোখের তারা।
প্রতিবছরই শীত মৌসুমে হাকালুকি হাওরের অন্যরকম রূপ-সৌন্দর্য, এমন মনোরম চিত্র থাকে। তবে শীত আর গ্রীষ্ম দুই মৌসুমে হাকালুকি হাওরের দুইরকম রূপ-মাধুর্য। প্রকৃতির এমন উজাড় করা রূপ-সৌন্দর্য আকৃষ্ট করে যে কাউকে। বর্ষায় যতদূর দুচোখ যায় শুধু থই থই পানি। বিশাল জলরাশির মাঝখানে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে জেগে ওঠা সবুজ পত্রপল্লবের হিজল, করচ আর কতো কি নয়ন কাড়া সবুজ জলজ বনের রাজ্য। আর শীত মৌসুমে শুধু সবুজ ঘাসের বিস্তৃত মাঠ। তখন হাওরজুড়ে গরু, মহিষের বাতান। আর হাওরের বিলে খাদ্যের সন্ধানে অবাধ বিচরণ করে নানা জাতের দেশি ও অতিথি পাখিরা। তখন প্রকৃতির মানসকন্যা হাকালুকি শুধু পাখি নয়, পর্যটক বরণেও প্রস্তুত থাকে।
শীতকালে হাকালুকি হাওর ভ্রমণের সেরা সময়। পাখিদের পাশাপাশি মানুষেরও ঢল নামে। তাই নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসটাই হাওর ভ্রমণের সেরা সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। জলজ উদ্ভিদ আর মাছপ্রেমীদের জন্যও এ সময়টা সেরা। এ সময়ে এই হাওর থেকে প্রচুর মাছও ধরা হয়। তাই এ সময় এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। যারা সারা বছর অপেক্ষার প্রহর গুনে গুনে দিন পার করেছেন তাদের কাছে এ সময়টা মাহেন্দ্রক্ষণ। কর্মব্যস্ততা দূরে ঠেলে পাখিদের সঙ্গে তারাও মনের পাখা মেলে উড়ে বেড়ান মুক্ত আকাশে। মুক্তির স্বাদ আস্বাদনে তারাও পাখির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হন। রঙবাহারি পাখিদের রূপ-মাধুর্যে রাঙিয়ে দেয় মনের উঠোন।
শীতকাল আমাদের দেশে উপযুক্ত বাসস্থান ও খাবার পাওয়ার কারণে দেশের স্থায়ী পাখিদের সঙ্গে যোগ হয় পরিযায়ী পাখির দল। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শীতকালে আমাদের দেশে আসে। জীবনধারণের প্রয়োজনেই এদের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে আসা-যাওয়া করতে হয়। পরিযায়নের সময় অধিকাংশ পাখি রাতেই চলাচল করে। এসব পাখিদের কেউ দিবাচর, কেউবা নিশাচর। শীতকাল শেষে আবার তারা চলে যায় অন্য দেশে। এ পাখিগুলোকে বিজ্ঞানীরা পরিযায়ী পাখি বললেও সাধারণ মানুষের কাছে এরা অতিথি পাখি বা শীতের পাখি বলে পরিচিত। শীতকালে আমাদের দেশে আসে বলে এ পাখিদের অতিথি পাখি বলা হয়। প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তারা অন্য দেশে পাড়ি জমায় এবং অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসে স্বদেশ ভূমিতে।
সৌন্দর্যের আধার পাখি শুধু আমাদের মনের ক্ষুধাই মেটায় না, পতঙ্গভূক পাখি নানা প্রজাতির ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে রক্ষা করে। মৎস্যভূক পাখি অসুস্থ ও দুর্বল মাছ খেয়ে অন্যান্য মাছ ও জলজ পরিবেশ ভালো রাখে। ইঁদুরভূক পাখি ইঁদুর খেয়ে কৃষকদের উপকার করে। এসব পাখি হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিলে অবস্থান করে বলে এদের বিষ্ঠা মাটিতে জমা হয়ে মাটিকে ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ করে তোলে। এগুলো জৈবসার হিসেবে কাজ করে মাটিকে উর্বর করায় ভালো ফসল উৎপাদন হয়।
বর্তমানে বৈরী জলবায়ু আর মানবসৃষ্ট কারণে হৃদয় প্রফুল্ল করা মনের ক্ষুধা মেটানো লাখ লাখ পরিযায়ী পাখির ঐকতানে দৃশ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দেশের অনেক জলাভূমি ভরাট হয়ে গেছে। বন উজাড় হচ্ছে। মাটি দিয়ে আর জলাভূমি ভরাট নয়, গাছ কেটে বন উজাড় করে আর পাখির আবাসস্থল ধ্বংস নয়, কৃষি জমিতে বিষ প্রয়োগ করে আর নয় পাখির অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন করা। প্রকৃতির অলংকার হিসেবে পরিবেশ ও পর্যটনের জন্য স্থায়ী ও পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল, জলাভূমি সংরক্ষণ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করি- এটাই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী ও মামুন পরিবহনের বাস যায় কুলাউড়া শহরের উত্তর বাজারে। ভাড়া ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। কমলাপুর থেকেও ছেড়ে যায় বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেন। ছোট্ট শহরে রয়েছে থাকার মতো কয়েকটি আবাসিক হোটেল, বোর্ডিং। আগে বুকিং না দিলেও হবে। উত্তর বাজার থেকে সিএনজি পাওয়া যায় হাকালুকি হাওরে যেতে। যদি হাওর ছাড়া আরও কিছু দেখতে হয় তাহলে ট্যাক্সি অথবা মাইক্রো নেওয়াই উত্তম। ভাড়া নেবে একদিনে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। দুই দিনের ভ্রমণে খরচ জনপ্রতি ৩২০০-৩৫০০ টাকা মাত্র।
Comments 0